সচিবালয়ে একই সময়ে তিন স্থানে আগুন নিয়ে রহস্যের জাল সহসাই ছিঁড়ছে না। সেই স্থাপনায় মধ্যরাতে আগুন নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই। আগুন লাগার ধরন দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ‘পরিকল্পিত নাশকতা’ হতে পারে। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ‘শর্টসার্কিটের মাধ্যমে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে’ এমন প্রাথমিক ধারণাকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটাও এক ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছে। কারণ ইতিপূর্বে সচিবালয়ে যে পাঁচটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সবকটি ঘটনাই ঘটেছে শর্টসার্কিট থেকে। এসব অগ্নিকাণ্ডে প্রতিটির ক্ষয়ক্ষতি ও ভয়াবহতা খুবই সামান্য এবং টাকার অঙ্কে গণনার মতো নয়। রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-আন্দোলনের নেতারা বলেছেন—‘এটি পরিকল্পিত আগুন’। এক্ষেত্রে বলা যায় যে, সচিবালয়ের ভেতরে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদের ব্যর্থতা যেমন ছিল, তেমনি তৃতীয় কোনো পক্ষ সুযোগ নিতে পারে।সচিবালয়ে আগুন লাগার ঘটনা উদঘাটন ও সচিবালয়ের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে সুপারিশ করতে আট সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ইয়াছির আরাফাত খান গতকাল রাতে ইত্তেফাককে বলেন, তদন্তের কাজ আমরা করছি। শনিবারও আমরা ঘটনাস্থলে গিয়েছি। আমরা প্রত্যক্ষদর্শীসহ ঐদিন দায়িত্বপালনকারীদের বক্তব্য নিচ্ছি। আমরা সব দিক বিবেচনায় নিয়েই তদন্ত কাজ করছি।’আগুনের ঘটনা নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন। ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ একটি বিদেশি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দুর্ঘটনাজনিত শর্টসার্কিট হতে পারে, আরেকটি পরিকল্পিতভাবে শর্টসার্কিট দিয়ে আগুন সৃষ্টি করা যেতে পারে। এই আগুন দেখে মনে হচ্ছে না, স্বাভাবিক শর্টসার্কিট থেকে এটা হয়েছে। পরিকল্পিত শর্টসার্কিটের জন্য ঐ ছয় তলায় থাকতে হবে না। আগে থেকে পরিকল্পনা করে দুটি বৈদ্যুতিক তার একসঙ্গে লাগিয়ে বারুদ, গান পাউডার কিংবা কেমিক্যাল রেখে নিচে বৈদ্যুতিক প্লাগ অন করলে বৈদ্যুতিক স্পার্কের কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের আরেক জন সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আলী আহমেদ খান ঐ বিদেশি গণমাধ্যমকে বলেন, সচিবালয়ে আগেও একাধিকবার আগুন লেগেছে। পিডাব্লিউডি কাজও করেছে। আবার কেন তাহলে আগুন লাগল? আমরা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এভাবে কখনো দুর্ঘটনার আগুন লাগে না। দুর্বৃত্তরা যখন আগুন লাগায় তখন একসঙ্গে একাধিক স্থানে আগুন লাগে। এটা শর্টসার্কিট না, আগুন লাগানো হয়েছে।’সংশ্লিষ্ট একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ৯ তলা ভবনের সাত তলা, ছয় তলা এবং আট তলায় পৃথক তিন স্থানে একই সময়ে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা গেছে। শর্টসার্কিটের ঘটনা ঘটলে সেই আগুন একই ফ্লোরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়বে। আগুন এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে একই সময়ে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ নেই। কারণ, সচিবালয়ের ভবনগুলোতে প্রতিটি ফ্লোরে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পৃথকভাবে সার্কিট ব্রেকার বসানো রয়েছে। ইচ্ছা করলে যে কেউ একটা ফ্লোরের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ও চালু করতে পারবে। শর্টসার্কিট হলে নির্দিষ্ট ঐ ফ্লোরেই আগুন একই সময় ছড়িয়ে পড়বে। অন্য ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ নেই।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, সচিবালয়ের পুরোনো কোনো ভবনই অগ্নিঝুঁকিমুক্ত নয়। মাঝে মধ্যেই আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। তবে সেগুলোতে বড় কোনো ক্ষতি হয়নি। এর আগে গত ১ আগস্ট সচিবালয় ক্লিনিক ভবনে (৯ নম্বর ভবন) নিচ তলায় সিঁডিকোঠায় বিদ্যুতের মেইন ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ডে শর্টসার্কিট থেকে (এমডিবি) আগুন লাগে। তবে সচিবালয়ের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাৎক্ষণিক আগুন নিভিয়ে ফেলেন। ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি সচিবালয়ে ৬ নম্বর ভবনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অগ্নিকাণ্ড হয়। ৬ নম্বর ভবনের সপ্তম তলায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৬০৬ নম্বর কক্ষে ফলস সিলিংয়ের সঙ্গে থাকা টিউব লাইটের স্টার্টারে আগুন লাগে। এতেও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।এর আগে ২০১৯ সালের ৭ জুলাই সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের সপ্তম ও অষ্টম তলার মাঝামাঝি স্থানে বৈদ্যুতিক বোর্ডরুমে শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগে। গ্যাস সরবরাহ লাইন থেকে ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর সচিবালয়ের ক্লিনিকের পেছনে গণমাধ্যম কেন্দ্রের সামনে উত্তর দিকের দেওয়ালে আগুন লাগে। সেই ঘটনায় তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ৪ নম্বর ভবনের সপ্তম তলায় ৬২৯ নম্বর কক্ষে শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগে।
ফায়ার সার্ভিসের সূত্র জানায়, বিগত ছয় বছরে সচিবালয়ে পাঁচটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসব অগ্নিকাণ্ডের কোনোটাতেই বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। গ্যাস লাইনের দুর্ঘটনা ছাড়া বাকি চারটি ঘটনায় আগুনের সূত্রপাত হয়েছে শর্টসার্কিটের মাধ্যমে। এসব ঘটনায় উল্লেখ করার মতো ক্ষতিও হয়নি।সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সচিবালয়ের পুরোনো ৯টি ভবনের মধ্যে ৪, ৬ ও ৭- এ তিনটি ভবন সবচেয়ে বড়। ৭ ও ৪ নম্বর ভবন দুটি নির্মাণ করা হয়েছিল ষাটের দশকে। ৬ নম্বর ভবনটির নির্মাণকাল আশির দশকের শেষ দিকে। এই তিনটি ভবনের সবকটিতেই বাইরের দিকে কোনো বারান্দা নেই। ৪, ৬ ও ৭ নম্বর ভবনের দুই পাশে রুম, মাঝে চলাচলের রাস্তা। কয়েক বছর আগে ১ নম্বর ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সবচেয়ে বড় ২১ তলাবিশিষ্ট ভবন ৬-এ প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও মন্ত্রিসভা কক্ষ স্থানান্তর করা হয়। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অন্যান্য দপ্তর ১ নম্বর ভবনেই আছে।